সংবাদ শিরোনাম
Home / প্রথম পাতা / লালবেগ বিএমডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঃ নিহত অর্ধশতাধিক

লালবেগ বিএমডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঃ নিহত অর্ধশতাধিক

মোঃ জাহাঙ্গীর আলম,সীতাকুণ্ড টাইমস ঃ

সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপুতে ভায়াবহ বিস্ফোরনে আগুনে পুড়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মিসহ ৪৫ জনের মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার দিবাগত রাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থেকে রাসায়নিক পণ্যের কন্টেইনার বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিস্ফোরণে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ কারখানাটির দুই শাতাধিক শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয়েছে।

সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির বেসরকারী একটি কন্টেইনার বিএম ডিপুতে স্বরণকালের ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে রবিবার দিনব্যাপি মরদেহ উদ্ধারে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস পুলিশ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা ।

নিহতদের মধ্যে পাঁচ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। কুমিরা ফায়ার স্টেশনের নার্সিং অ্যান্টেনডেন্টস মনিরুজ্জামান (৩২), মমিনুল হকের (২৪) বাড়ি বাঁশাখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের মধুখালী গ্রামে। তিনি ফরিদুল আলমের ছেলে। অন্যজন একই উপজেলার পূর্ব চারিয়ার নাপোড়া এলাকার মাহমুদুর রহমানের ছেলে মো. মহিউদ্দীন (২৪), ভোলা জেলার হাবিবুর রহমান (২৬),রবিউল আলম (১৯), বাঁশাখালীর চনপাড়ার এলাকার আবব্দুল মজিদের ছেলে। এর মধ্যে মহিউদ্দীন বেসরকারি পার্ক ভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

শনিবার রাতে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলের চতুর দিকের অন্তত ৪/৫ কিলোমিটার এলাকা বিকট শব্দে প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠে। এতে ঘর বাড়ি মসজিদ ও বিভিন্ন অফিস দোকান পাটের কাঁচের দরজা জানালা ভেঙ্গে পড়ে, ফাটল ধরেছে পাকা দেয়ালে। পুরো এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের পর বিএম ডিপুর আশপাশের গ্রাম গুলো থেকে চলে গেল নারীপুরুষ।
রবিবার রাতে বিস্ফোরনের পর বিএম ডিপুর ২ নং গেইট দিয়ে অগ্নিদগদ্ধদের বের করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠিয়েছে স্থানীয় স্বেচ্ছা সেবকদলও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
সারারাতও আগুন নিয়ন্ত্রণ আনা যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে ইউনিট আরও বাড়ানো হয়। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের ১৮৩ কর্মী আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। এর মধ্যে ঘটনাস্থলে সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়ি ও ফেনীর, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, বান্দরবান থেকে এসে সেচ্ছাসেবকরা উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করছেন। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে দগ্ধে আহত ও মৃতদের আনা নেওয়ার কাজে চারটি অ্যাম্বুলেন্স কাজ করছে।
এদিকে সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক বলেন, বিস্ফোরণে তাঁদের থানার কনস্টেবল তুহিনের এক পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাদের থানার আরও অন্তত পাঁচ কনস্টেবল, ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মোতাহার হোসেন এবং শিল্প পুলিশের একাধিক সদস্য আহত হয়েছেন। মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) নুরুল আলম বলেন, হতাহতদের মধ্যে ডিপোর শ্রমিকদের পাশাপাশি পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আছে।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৪০ জনের লাশ এসেছে। লাশগুলো হাসপাতালের মর্গে রাখা আছে। সকাল ৯টার পর যে লাশগুলো আনা হয়েছে, সেগুলো চেনার উপায় নেই। পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ টেস্ট করা লাগতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অধিকাংশরাই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। তাদের তথ্য আমাদের কাছে নেই। আহতদের মধ্যে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে ৮৪ জন। সেই সঙ্গে সিএমএইচ, বেসরকারি হাসপাতাল পার্ক ভিউ, ন্যাশনাল হাসপাতাল ও মেট্রোপলিটনসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অনেকে চিকিৎসাধীন আছেন। কয়েকজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানিয়েছেন, আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ কর্মী নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ২১ জন। আহতরা সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। কয়েকজন কর্মীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

অগ্নিকাণ্ডে নিহত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীর মধ্যে একজনের নাম মনিরুজ্জামান (৩২)। অন্যদের নাম জানা যায়নি। নিহতদের মধ্যে আরও চার জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন মোমিনুল হক, মহিউদ্দিন, হাবিবুর রহমান ও রবিউল আলম।

এদিকে আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল। আজ সকাল পৌনে ১০টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন এসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আশরাফ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা, আগুন যাতে আর ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য সেনাবাহিনীর ১৫০ থেকে ২০০ সদস্য অভিযানে অংশ নেন।

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ রাসায়নিক মজুতের জন্য লাইসেন্স নেয়নি বলে জানিয়েছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে যে ‘হাইড্রোজেন পারক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ দাহ্য রাসায়নিকের মজুত রয়েছে; এ কারণেই মূলত শনিবার রাতে আগুন লাগার পর শক্তিশালী বিস্ফোরণ হয়েছে।
হাইড্রোজেন পারক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। এটি যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। হাইড্রোজেন পারক্সাইডসহ বিপজ্জনক পণ্যগুলি কীভাবে নিরাপদে সংরক্ষণ এবং পরিবহন করা যায় সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘হাইড্রোজেন পারক্সাইড বা যেকোন রাসায়নিক মজুতের জন্য কোনো লাইসেন্স নেয়নি ডিপো কর্তৃপক্ষ। এমনকি এ বিষয়ে পরিদপ্তরকে কোনো কিছু অবহিতও করা হয়নি। এ ধরনের জায়গায় এত বেশি দাহ্য বা বিপজ্জনক পণ্য মজুদ করার কোনো সুযোগ নেই। এই ধরনের পণ্য সংরক্ষণ করার জন্য, বিশেষ অবকাঠামোর দরকার হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা আমাদের কাছ থেকে কোনো লাইসেন্স বা অনুমোদন নেয়নি। লোকালয় বেষ্টিত এই জাতীয় জায়গায় বিপজ্জনক পণ্য মজুত করার কোনো আইনি সুযোগ নেই। এ ধরনের রাসায়নিক সংরক্ষণের জন্য বিশেষ অবকাঠামোর দরকার হয়। যেখানে প্রয়োজন মতো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর অবশ্যই এটা নিশ্চিত করার বিষয় থাকে যে, এর আশপাশে কোনো লোকালয় নেই।

অন্যদিকে এ ঘটনা নাশকতা কি না, তা খতিয়ে দেখার অনুরোধ করেছেন বিএম কনটেইনার ডিপো মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ও নির্বাহী পরিচালক শহীদ উদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুন ও হতাহতের জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। এই মুহূর্তে নিহতের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আহত যারা হয়েছেন তাদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে সর্বোচ্চ ও যারা আহত হয়েছেন তাদের সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যয়ভার গ্রহণ করা হবে। একইসাথে নিহত ও আহত পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষনা দিচ্ছি।’

বিএম কনটেইনার ডিপো মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ও নির্বাহী পরিচালক শহীদ উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনসহ সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটিকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার ঘোষণা দিয়েছে। এটি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা বা কোন প্রতিপক্ষ দ্বারা ইচ্ছাকৃত অনিষ্টসাধন (সাবোটাজ) ঘটিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’

এদিকে বিএম ডিপুতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর চমেক হাসপাতালসহ সকল ক্লিনিকে ডাক্তার রক্তদাতা ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা পুড়ে যাওয়া মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে আসেন । সবাই রাতভর নিজ দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি সীতাকুণ্ডের এমপি দিদারুল আলম উপজেলা চেয়ারম্যান এসএমআল মামুন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহাদাত হোসেন,উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নুর উদ্দিন রাসেদ,সাংবাদিক নেতৃবৃন্দরা ছুটে যান হাসপাতালে। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক প্রচার হওয়ায় স্থানীয়রা সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *