সাইফুূল ইসলাম ইনসাফ,১৩মার্চ(সীতাকুণ্ড টাইমস)- ঃ নদীমাতৃক বাংলাদেশে জালের মত ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদনদী ,পুকুর ,হাওড়-বাওড়,খালবিল,নালা ডোবা,জলাশয় প্রভৃতি। আমাদের দেশে প্রায় নয় লাখ হেক্টরের বেশি এলাকা জুড়ে রয়েছে এসব জলাশয়। এসব জলাশয়ে প্রচুর পরিমানে মাছ উৎপাদিত হতো। হাজার হাজার বছর ধরে বাঙ্গালী ভাতের সাথে প্রতিদিন প্রতিবেলার আহারে মাছ সঙ্গী করে খেত বিধায় বাঙ্গালীকে বলা হয় মাছে ভাতে বাঙ্গালী। সময়ের আবর্তে জনসাধারনের অসচেতনতায় ,সরকারি অবহেলায়,জনপ্রতিনিধিদের উপেক্ষায় হারিয়ে যাচ্ছে বিশাল সংখ্যক মিঠা বা স্বাদু পানির মৎস্য প্রজাতি। সন্দ্বীপের বড় বড় খালগুলো ক্ষমতাবানরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে দখল করে নিচ্ছে। এমনকি অস্থায়ী ভাবে ইজারা নেয়া এসব খাল নালা ভরাট করে স্থায়ী ইমারত নির্মানের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সন্দ্বীপের বড় সড়ক সংলগ্ন খাল গুলো তে স্থায়ী ইমারত নির্মান করছে। কৃষকরা ফসলের মাঠে থাকা খাল নালা ডোবা ভরাট করছে ফসলী জমি বাড়ানোর জন্য । বাড়ির চারপাশের নালা ভরাট করে বাড়ির দৈর্ঘ্য বাড়াচ্ছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য গৃহ নির্মানে। একতাই বল এক সময়কার শক্তিশালী আপ্ত বাক্যটি মানুষ এখন ভূলতে বসেছে। ইচ্ছেমত পুকুরে ঝাঁকি জাল মেরে বা রাতে বরশি দিয়ে মাছ শিকার করায় আত্মকেন্দ্রিক ভাব সৃষ্টি হয় পরিবার গুলোতে। তাইতো বাড়ির সদস্যদের অনৈক্যের কারণে বাড়ির পুকুরগুলো তে পাম্প বসিয়ে বছরে একবার পানি সেচন করে মা মাছসহ সব মাছ শিকারের ফলে পরবর্তী বর্ষা মৌসুমে মাছের প্রজনন ব্যর্থ হওয়ায় ক্রমশঃ মাছ শূন্য হচ্ছে মিঠা পানির পুকুর গুলো। পূর্বে ফসলের মাঠে থাকা ডোবা (স্থানীয় নাম দৌল্লা খাডি,ছোট খাডি) গুলো শুকনো মৌসুমে মাছ ধরার পর কিছু মা মাছ থেকে যেত । পরবর্তী বর্ষায় নতুন পানিতে প্রজনন করে মাঠ ভর্তি প্রচুর মাছ উৎপাদিত হত। বর্তমানে একদিকে যেমন ডোবা,খাডি,নালা ভরাট করা হয়েছে ফসলী জমি বাড়ানোর প্রতিযোগিতায়,অন্য দিকে শুষ্ক মৌসুমে পাম্পদিয়ে পুরো পানি সরিয়ে মাছ ধরার কারনে কোন মা মাছ আর থাকছে না পরবর্তী বর্ষার জন্য। পূর্বে খোলা শৌচাগার এলাকার উন্মুক্ত নালা গুলোতে মানুষ মাছ ধরত না ,এখন খোলা পায়খানা না থাকায় মা মাছের বেঁচে থাকার আর কোন ভরসায় রইল না। অবশিষ্ট যে মাছগুলো কোন রকমে প্রজাতি রক্ষা করছিল সেগুলো ফসলের মাঠে বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার কলকারখানার বর্জ্য,অপচনশীল সামগ্রীর বিষক্রিয়ায় এবং অবৈধ কারেন্ট জাল ব্যবহারকরে মাছ শিকার করায় মিঠা পানির অনেক প্রিয় সুস্বাদু মাছ বিলুপ্ত হয়েছে বা বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশে প্রায় তের লক্ষ জেলে সরাসরি মাছ শিকারের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও বর্তমানে নদনদী ,জলাশয় গুলোতে মাছের পরিমান কমে যাওয়ায় জেলেরা পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ফেেল দেশের মানুষের প্রাণীজ আমিষের শতকরা ৬০ ভাগ চাহিদা যে মাছ দিযে পূরণ হতো এখন তা সম্ভব হচ্ছে না ্ বর্তমানে প্রতিদিন বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু মাছের চাহিদার পরিমান দাঁড়ায় ৩৩ গ্রাম। যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। প্রাণীজ আমিষের বেশির ভাগ চাহিদা মিটাচ্ছে এখন ব্রয়লার মোরগ,আমদানি করা গরুর গোশত,বাণিজ্যিক উপায়ে উৎপাদিত সরপুটি, পাঙ্গাস,রুই,কাতলা,মৃগেল,তেলাপিয়া,কার্পজাতীয় মাছ,নাইলেটিকা,অষ্ট্রেলিয়ান মাগুর,কৈ প্রভৃতি। ইদানিং আমাদের মৎস্য গবেষকরা পরীক্ষামূলক ভাবে মিঠা পানির ইলিশ উৎপাদনের ঘোষনা দিলেও বাণিজ্যিক ভাবে তা উৎপাদনের কার্যক্রম এখনো দেখা যায়নি। সন্দ্বীপের পূর্ব পশ্চিমের বেড়ী বাঁধে অপরিকল্পিত সংকীণ স্লুইস গেইট নির্মানের বিষয়ে কোন কোন পানি বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন। এ সব সংকীর্ণ স্লুইস গেইটের কারণে সাগরের মাছ বর্ষায় চরাঞ্চলে প্রবেশ করতে না পারায় মিঠা পানিতে সাগরের মাছের প্রজনন সম্ভব হয়না। পুর্বে আমাদের দেশে প্রায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদু বা মিঠা পানির মাছ ছিল। বর্তমানে এদের মধ্যে প্রায় ৫৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত বা বিলুপ্তির পথে। এক সময় সন্দ্বীপে বর্ষার পুর্বে বা বৈশাখীর প্রথম জোয়ার বা ঢলে মানুষ ঝাঁকি জাল পেতে আন্তা ছাই,ঠনা ছাই,ডোগ ছাই,হলা ছাই বসিয়ে প্রচুর মাছ ধরত। বৈশাখী ঢলের পূর্বে দ্বীপের অভ্যন্তরের খালগুলোতে জোয়ারের সাথে প্রচুর সাগরের মাছ প্রবেশ করত। কিন্তু কতিপয় সুবিধাবাদি ক্ষমতাবানরা খাল ভরাটের সাথে সাথে খালে বাঁধ দিয়ে পানি আটকিযে মাছের প্রজনন ব্যাহত করছে। বর্ষায় এখন অতিবৃষ্টির ঢলে শুধু পানিই থাকে,থাকেনা মাছের সে ঐতিহ্যবাহী প্রাচুর্য। সন্দ্বীপ এলাকায় বিলুপ্ত বা বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাওয়া মাছ গুলোর মধ্যে-চিংড়ি,(ইছা,টোলকা ইছা,লল্লা ইছা,হেউড্ডা ইছা,কক কড়য়া ইছা,গলদাচিঙড়ি,বাগদা,চিঙড়ি,ছইছাইছাইত্যাদি),কৈ,মাগুর,শিং,টাকী,শোল,টেংরা(গুলামাছ),বাঁটা,ছোটপুঁটি,সরপুঁটি,তিতপুটি,খলিশা(খইস্যা))খোকসা,বোয়াল,ভেটকি,আঁইড়,ফলি(হোয়াল্লা)তারাবাইম,পাবদা,মলা,ঢেলা,বাতাসি,চাপিলা,পোয়া,রিটা,মহাশোল,চিতল,কালিবাউস,দারকিনা,বাইল্লা(বাইলা) ,কাচকি বৈছা,শিলং/শিলট অন্যতম। মিঠা পানির শামুক ঝিনুক,কচ্ছপ,কুচিলা,ঢোঁড়াসাপ,লাল কাঁকড়া,মাটিয়া সাপ,ও বিলুপ্তির পথে। কারেন্ট জাল কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ , পাম্প মেশিনের মাধ্যমে কোন জলাশয় যাতে পুরো সেচন না হয়,সে জন্য স্থানীয় ইউপি সদস্য এর মাধ্যমে জনসচেতনতা কমিটি গঠন,স্বাদু পানির মাছ চাষে উৎসাহিত করা,প্রচার মাধ্যমগুলোতে মিঠা পানির মৎস্য রক্ষায় ব্যাপক প্রচার ,সর্বোপরি জনসচেতনতার মাধ্যমে এ সকল মাছের প্রজাতি রক্ষার মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। এদিকে সন্দ্বীপের নিকটের লোনাপানির মৎস্য ও আশংকাজনক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। কোন কোন সময় ভরা মৌসুমেও ইলিশের সন্ধান মেলেনা । কিছু মিললেও মৎস্য দস্যুরা জেলেদের কমদামে মাছ বিক্রিতে বাধ্য করে। এসব মাছ শহরে বিক্রি করায় সন্দ্বীপের বাজার গুলোতে সামুদ্রীক মাছের সংকট দিন দিন তীব্র হতে যাচ্ছে। এছাড়া কয়েক হাত পেরিয়ে বাজারে যে মাছ আসে তাও চড়া দামের জন্য মধ্যবিত্তরা টাটকা ইলিশের স্বাদ গ্রহণে অক্ষম হয়। চতুর মাছ ব্যবসায়ীরা মাছকে এমন ভাবে সাজিয়ে মাছের পসরা সাজ্য়া তাতে ভাল মাছ কেনা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে। রং মেশানো ,ফরমালিন মেশানো মাছ ব্যবসায়ীদের নিত্যকর্মে পরিণত হয়।