সংবাদ শিরোনাম
Home / আইন আদালত / মোবাইল, এই যেন এক আসক্তির নাম

মোবাইল, এই যেন এক আসক্তির নাম

আরিশা কানিজ,সীতাকুণ্ড টাইমস ঃ

এমন লাখ লাখ শিশু কিশোর রয়েছে সীতাকুণ্ডে, যারা অনলাইন গেইম এর জন্য প্রতিনিয়ত পিতা মাতার অবাধ্য হচ্ছে। এই অনলাইন গেইমই যেন তাদের সবকিছু হয়ে উঠেছে। অনলাইন গেইম এ আসক্তির কারণে শিশুর আচরণে দেখা দিচ্ছে নেতিবাচক প্রভাব। এ যেন মাদকের চেয়ে ভয়াবহ রুপ।

আর তরুণদের কাছে অনলাইনে ভিডিও গেম খেলা যেন নিত্য দিনের সঙ্গী। বাড়িতে কিংবা গাড়িতে, স্কুলে-কলেজে কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় মোবাইলে ভিডিও গেম খেলায় ব্যস্ত হয়ে যায়। গেমস গুলোতে মূলত মারামারি, রক্তপাত ও উত্তেজনাপূর্ণ রসদ দিয়ে এসব গেম তৈরি করা হয়। যার ফলে যারা গেম খেলে তাদের মধ্যে জিঘাংসা, জেদ, রাগ ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। যা কোমলমতি শিশুদের মানসিক বিকাশের অন্তরায়। শুধু শহরে নয়, ভিডিও গেমসের দিকে ঝুঁকছে গ্রামের শিশু-কিশোররাও। শিশু কিশোররা একত্রে দলবেঁধে ভিডিও গেম খেলছে। খেলার মাঠ থাকা সত্ত্বেও ভিডিও গেমের দিকে ঝুঁকে পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অভিভাবকরা। তারা জানান, এসব গেমে আসক্তির কারণে কিশোররা পারিবারিক, সামাজিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে।

মোবাইল আসক্তি নিয়ে আমরা কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সাথে কথা বলেছি।

( সীতাকুণ্ড সরকারি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র) নিহাল : আমি মোবাইল এ মেসেঞ্জারে বন্ধুদের সাথে কথা বলি। আবার ফেইসবুক এ বিভিন্ন ছবি এবং ভিডিও দেখি। অনলাইন গেইম খেলি যেখানে বন্ধুদের সাথে কথা ও বলা যায়।

(টেকনিক্যাল স্কুল এর ছাত্র) রাকিব : আমাদের বেশির ভাগ পড়া অনলাইন থেকে নিতে হয়, এর জন্য আমার স্মার্ট ফোন লাগে। পড়া নেওয়া শেষে আমি ফেইসবুক ব্যবহার করি।

(সীতাকুণ্ড বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী) রাহি : যখন থেকে স্কুলের টিচাররা অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করে তখন থেকেই আমি মোবাইল ব্যবহার করি। করণ আমাকে অনলাইনে ক্লাস করতে হতো।

(মোবাইল আসক্তি সম্পর্কে অভিভাবকরা যা বলছেন)

নাজমা বেগম (অভিভাবক) : বাচ্চাদের পড়া নাকি অনলাইনে দেওয়া হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইল নিয়ে বসে থাকে, কি করছে জিজ্ঞেস করলে বলে পড়া নিচ্ছি। পরে দেখা যায় গেইম খেলছে।

সাজেদা খানম (অভিভাবক) : মোবাইল না দিলে খেতে চাই না, পড়তে চাই না। করোনা কালিন সময় থেকে ছেলে -মেয়েরা মোবাইল আসক্ত হয়ে পড়েছে। ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে, পড়া দিচ্ছে অনলাইনে। পরে দেখা যাই কি ওরা পড়ারচেয়ে বেশি ফেইসবুক ব্যবহার করছে।

আমরা ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের সাথে কথা বলে কিভাবে কিশোর কিশোরী শিক্ষার্থীরা মোবাইল আসক্তিতে জড়িয়ে পড়েছে সে সম্পর্কেও জানলাম।

মোবাইল আসক্তির কারণে শিশুদের নানাবিধ সমস্যা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তাকে স্মার্টফোন দেওয়া আর একবোতল মদ কিংবা এক গ্রাম কোকেন তুলে দেওয়া সমান।

শিশু অতিরিক্ত স্ক্রীনে তাকিয়ে থাকার কারণে চোখের সমস্যা বাড়ছে। শিশুদের অল্পতেই রেগে যাওয়া, বিষন্নতা, মনোযোগের অভাব এরসবই অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের কারণে হয়ে থাকে। অনেকের কাছেই, মোবাইলের আসক্তি বলে কিছু নেই। প্রযুক্তির সাথে থাকায় তো ভালো! কিন্তু সব ভালো কি আসলেই ভালো? সেরকমই একটি ভালো এই স্মার্টফোন আসক্তি।

অন্যসব আসক্তির মতোই অনলাইন গেমে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ভালো লাগে; না থাকলে শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতা দেখা দেয়। আবার দীর্ঘক্ষণ অনলাইনে থাকার ফলে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়। যেমন অনেকের ঘুম কম হয়। যার ফলে ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব লেগেই থাকে। তাদের মধ্যে অনুশোচনাবোধও দেখা যায়। অনেকের সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা কমে যায়, ফলে তারা একাকীত্বে ভোগে।

বিশ্বজুড়ে এই ধরনের অ্যাডিকশনের বিষয়ে প্রকাশিত ১৬টি গবেষণাপত্র অ্যানালাইসিস করে বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ৪.৬% ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্তিতে ভুগছে। তাদের মধ্যে ৬.৮% হচ্ছে কিশোর আর ১.৩% কিশোরী। অধিকাংশ মোবাইল গেমই হলো যুদ্ধের গেম। আর এই যুদ্ধের গেম খেলতেই বেশি আগ্রহ শিশু-কিশোর বা শিক্ষার্থীদের। প্লে-স্টেশনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা একটি গেমের প্রায় অধিকাংশ অংশই দেখা যায় যুদ্ধ, সহিংসতা ও রক্তপাত-সংক্রান্ত।

সীতাকুণ্ড সহ সারা বাংলাদেশে ভিডিও গেমের প্রতি শিশু-কিশোরদের আগ্রহ নতুন কিছু নয়। তবে এই আসক্তিকে সম্প্রতি ‘মানসিক রোগের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরে বলছিলেন, ভিডিও গেমের অতিরিক্ত আসক্তিতে একদিকে যেমন শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি মেধা বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ইন্টারনেট আসক্তির প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই এ শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেট আসক্তি ও মোবাইল ফোনে গেমিং আসক্তি দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।

বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ইন্টারনেটের গ্রাহক ছিল, যাদের মধ্যে ৮ কোটি ৭৯ লাখ ব্যবহারকারী মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়। এছাড়া বিটিআরসির ২০১৬ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৩৫ শতাংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী, অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরী। বর্তমানে হয়তো এর পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পয়েছে।

মোবাইল গেমের প্রভাবে ধীরে ধীরে বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে সন্তান। ফলে সন্তানদের মোবাইল গেমিং থেকে বিরত রাখতে অনেক অভিভাবক নাস্তানাবুদ। এ ধংসাত্মক নেশা থেকে তরুণদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে সরকার ও জনগণ, তথা দায়িত্ববান অভিভাবকদের।

শিশুদের মোবাইল গেমিং আসক্তি কমিয়ে আনার জন্য অভিভাবকরা সন্তানদের সময় দিন। মাঠে খেলাধুলা করতে উদ্বুদ্ধ করুন। শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার কোন বিকল্প নেই। বই পড়তে দিন। বাই বা স্কুল কলেজে কার সাথে মিশছে খেয়াল রাখুন। তাহলে হয়তো মোবাইল আসক্তি কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

######
লেখকঃ
আরিশা কানিজ
ফেলো, রেডিও সাগর গিরি,
সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *