সংবাদ শিরোনাম
Home / প্রথম পাতা / আমাদের শিক্ষাঙ্গনঃ শিক্ষক- শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ভূমিকা

আমাদের শিক্ষাঙ্গনঃ শিক্ষক- শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ভূমিকা

সীতাকুণ্ড টাইমস ডেস্ক ঃ
আমাদের শিক্ষাঙ্গন ঃ শিক্ষক- শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ভূমিকা -শামসুদ্দীন শিশির,

শিক্ষাঙ্গন যেখানে শিক্ষা দেয়া নেয়ার খেলা চলে। দুটো জীবন্ত প্রাণের আন্তরিক সম্পর্কটি অতি কাছে আসার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। যাকে আমরা শ্রেণিকক্ষ বলি। এই শ্রেণিকক্ষ গুলো অবশ্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আমরা শিক্ষাঙ্গনও বলি। পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান। যে স্থানে নির্দিষ্ট কোন ধর্মের মানুষের সন্তানের পাঠদান ও পাঠ গ্রহণের কাজটি চলেনা। এখানে সকল ধর্ম বর্ণের জাতি-গোত্র , ধনী-গরীব এবং নানান পেশার মানুষের সন্তান গুলোকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার দীক্ষা দেওয়া হয়।
কিন্তু আমাদের এই পবিত্র শিক্ষাঙ্গন গুলো নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। যেখানে আগামীর সমৃদ্ধ জাতি গঠনের চাষাবাদ করা হয় সেখানেই যদি সমস্যা থাকে তা হলে আমরা সমৃদ্ধ জাতি গঠনে পিছিয়ে পড়বো। তাই প্রথমে শিক্ষাঙ্গনের সৌন্দর্য ও পবিত্রতা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। তা শুধু শিক্ষকদের মাধ্যমে সম্ভব নয়, কেবল শিক্ষার্থীরাই এর সমাধান করবে তাও নয়, অভিভাবকদের একার প্রচেষ্টায় সম্পন্ন হবে এমনও বলা যাবে না। তা হলে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে সম্মিলিত ভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অভিভাবক এবং সমাজের সচেতন নাগরিক সবাইকে। একটি শিক্ষাঙ্গনকে শ্রেষ্ঠ , সুন্দর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার জন্য যোগ্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান, দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, আগ্রহী ও মনোযোগী শিক্ষার্থী এবং সচেতন অভিভাবক থাকা একান্ত আবশ্যক।
দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, শিক্ষা ব্যবস্থার দুটি মুখ্য উপাদান হলো ক. ছাত্র সম্প্রদায় এবং খ. শিক্ষক মণ্ডলী। তিনি স্কুলে শিক্ষকের ভূমিকা ওপর সব চাইতে গুরুত্ব দিতে বলেন, “ আধুনিক বিশে^ স্কুল শিক্ষক কে কদাচিৎ তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে দেওয়া হয়। শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ম্যানেজিং কমিটি তাঁকে নিয়োগ করেন এবং যদি দেখা যায়, যে তিনি প্রকৃত শিক্ষা দিচ্ছেন তাহলে তাঁকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা রাখা নেই । এ কথা সত্য শিক্ষার সাথে যত গুলো পক্ষ জড়িত তাদের মধ্যে শিক্ষক হচ্ছেন সর্বোত্তম। প্রগতির জন্যে মূলত তাঁর সাহায্য আমরা নিতে পারি। শিক্ষা সম্পর্কে অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী হয়। শ্রমজীবী বাবা-মা চান তাদের সন্তান দ্রুত শিক্ষা শেষ করুক, যাতে তার আয় থেকে সাহায্য পাওয়া যায়। অন্যদিকে উন্নত শিক্ষাপ্রাপ্ত বলে পেশাজীবীরা বেশি প্রতিযোগিতা মূলক সমাজে গড়পরতা মা-বাবা তাঁদের ছেলে মেয়েদের জন্য উত্তম শিক্ষা চান না। তাঁরা এমন শিক্ষা চান, যা অন্য লোকদের প্রাপ্ত শিক্ষার চেয়ে ভালো। শিক্ষার সাধারণ মান নিচু রেখেই এটা করা সম্ভব। আর এ কারন আমরা আশা করতে পারিনা যে, শ্রমজীবী সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে একজন পেশাজীবী আগ্রহী হবেন।
একজন পেশাজীবী আপন সন্তানদের জন্য যে সব সুব্যবস্থা বজায় রাখতে চান, যদি সাধারণের জন্য তাঁর সহানুভূতিশীল মনোভাব তীব্র না হয় তাহলে তিনি সে সব সুব্যবস্থা ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ মানুষের সন্তানরাও পাক তা চাইবেন না। আমাদের সমাজের বৈষম্য এখানেই। তাই দ্বন্দ্বটা ও বেশি। এক কথায় উচ্চ বিত্তের মানুষেরা যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকেন সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছ থেকে। তা নিম্ন বিত্তের ব্রাত্যজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক তা রাষ্ট্র ও সমাজের অধিকারীরা কোন মতেই চাইবেন না। আর তাই অন্যসব ক্ষেত্রের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রেও অনাকাঙ্খিত বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এ বৈষম্য দূর করা যাবে শিক্ষক, অভিভাবক, প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাতা, ম্যানেজিং কমিটি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে, একটি সমঝোতা চুক্তি করে। নয়তো সুশিক্ষায় পিছিয়ে থাকা আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি আরো পিছিয়ে যাবে। আমরা জানি একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নানাবিধ ব্যয় মেটাতে হয়। তার জন্য অর্থও প্রয়োজন আছে। সে অর্থ প্রতিষ্ঠান গুলো শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায় করেন। এটা একটা সুন্দর প্রক্রিয়া। কিন্তু অভিভাবকের সাধ্যের ব্যাপারটিও প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যারা থাকেন তাদের মাথায় রাখতে হবে। তবেই সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সন্তান গুলো শিক্ষালাভের সুযোগ পাবে। আমাদের সকল সচেতন নাগরিককে খেয়াল রাখতে হবে শিক্ষা যাতে কোন ভাবেই পণ্যে পরিনত না হয়।
স্বামী বিবেকানন্দের মতে, প্রত্যেক শিশুই অনন্ত শক্তির অধিকারী, সেই সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। যে কাজটি শিক্ষক সকল বাধা অতিক্রম করে সুনিপুন ভাবে সম্পন্ন করেন যাতে শিশুর জীবন ও চরিত্র গড়ে ওঠে, প্রকৃত মানুষ তৈরি হয়। শিক্ষাঙ্গনে ইতিবাচক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ তৈরি করে দেন।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বিদ্যালয় গুলো ‘অচলায়তন’ বিদ্যালয়কে তিনি অভিহিত করেছেন শিক্ষার কারখানা নামে। স্কুল গুলো সম্পর্কে তাঁর এমন ধারণার কারণ স্কুল গুলো সমাজ বিচ্ছিন্ন। তাঁর মতে বিদ্যালয় যেখানে চারিদিকে সমাজের সঙ্গে এমন এক হইয়া মিশিতে পারে নাই, যাহা বাহির হইতে সমাজের উপর চাপাইয়া দেওয়া, তাহা শুষ্ক তাহা নির্জীব। সমাজ ও অভিভাবকের উপর চাপিয়ে দিয়ে আর যাই হোক শান্তি পূর্ণ পরিবেশে পাঠদান ও গ্রহণের কাজটি যথাযথ ভাবে চলবে না এ কথা প্রমাণিত সত্য। রবি ঠাকুর প্রকৃত শিক্ষা বলতে বুঝিয়েছেন, তাহা মানুষকে অভিভূত করে, তাহা মানুষকে মুক্তিদান করে। অন্যত্র আরো বলেছেন, আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয়না সত্য দেয়, যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয় । ছাত্রদের অমনোযোগিতা ও ব্যর্থতা প্রসঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছেন, আমরা শিক্ষকরাই তার জন্য বহুলাংশে দায়ী, আমরা তাদের সামনে বস্তুর পাহাড় তুলে ধরেছি আর চেয়েছি সেই পাহাড়ই তারা উদগীরন করুক। বস্তুর মর্মে যে সত্য নিহিত আছে, সেই সত্যের দ্বারে তো আমরা ছাত্রদের পৌঁছে দিতে পারিনি। ফলে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে শ্রমিক ও কল কারখানার মত। পদে পদেই তাই ছাত্ররা আজ বিদ্রোহ করে। তবু সব সমস্যাকে সমাধান করার জন্য শিক্ষা বিষয়ে সচেতনতা জাগ্রত করতে হবে। আর তা প্রথমেই অর্জন করতে হবে শিক্ষকদের জানি বড় বড় কাজ করার সুযোগ পান না আমাদের শিক্ষকরা। কিন্তু ছোট ছোট কিছু কাজ আমাদের করবার আছে।
শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবইয়ের পড়ার মধ্যে পাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে মূল্যবোধ শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, বিনয় ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করার দীক্ষা অবশ্যই আমাদের শিক্ষকদের দিতে হবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষক কোন নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত নয় তিনি সমাজেরও শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নির্ভরতা কমিয়ে মানসিক চাপ মুক্ত করতে সহায়তা করা শিক্ষকের একান্ত দায়িত্ব। পরীক্ষার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণ শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা হারাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ও সমান সচেতনতা প্রয়োজন। তাঁরাও অনেকটা যন্ত্রের মতো এ কোচিং থেকে ও কোচিং প্রাইভেট টিউশন ছুটে চলেন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি উদ্দেশ্য একটাই সন্তানের “এ” প্লাস, পরীক্ষায় পাস , সন্তান কতটা মানুষ হচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। কোন কোন অভিভাবক শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি পড়া দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে তা তিনি ভাবতেও পারেননি। শিশু সন্তানটি কতটা ভার বইতে পারবে সেই ভাবনাও অভিভাবকরা করেন না। এ ব্যাপারে অভিভাবক এবং সমাজকে অনেক বেশি ভাবতে হবে। আমরা সঠিক পথে চলতে চাই এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে চাই। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি পড়ার বইরের বাইরের বই পড়া, বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করা সমাজের সকলেই উচিৎ।
সমাজের প্রয়োজনেই বিদ্যালয়ের সৃষ্টি। মানুষের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা অর্জনই এর পেছনে কাজ করেছে। একদিকে ব্যক্তির চাহিদা অপর দিকে সমাজের চাহিদা এ দুয়ের সুষ্ঠু সমন্বয়ে কাজটি বিদ্যালয়ের মাধ্যমে সুচারু রূপে সাধিত হয়। আজকের শিশু আগামী দিনের সুনাগরিক। শিশুটি কীভাবে বেড়ে উঠছে তা অধিকাংশ বিদ্যালয়ের সুষ্ঠু কার্যক্রমের উপরই নির্ভর করবে। শিক্ষাঙ্গনে শিশুর শিক্ষা এমন হবে, যেখানে আগামী দিনের সমাজের একটি প্রতিচ্ছবি। সে ছবি কাল্পনিক হলেও অবাস্তব হবে না।
শিক্ষাদানের শিক্ষাঙ্গন আগামী দিনের ভাবী নাগরিক দের দায়িত্বে নিয়োজিত যে শিক্ষা তাদেরকে সমাজের উপযুক্ত সদস্য হিসেবে গড়ে তুলবে। আজকের শিশুরা আগামী দিনের প্রকৃত মানুষ হতে পারলেই তারা হতে পারবে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী। কেউ হবে শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, কবি, সাংবাদিক তৈরি হবে শিক্ষাঙ্গনেই। তাই শিক্ষাঙ্গনের শ্রেণিকক্ষই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত জীবনের প্রস্তুতির ক্ষেত্র। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশই বর্তমান সমাজের প্রয়োজন মত চাহিদা ও ভবিষ্যত সমাজের সম্ভাব্য চিত্রকে সামনে রেখে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তথা শিক্ষাঙ্গনে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টিতে সচেষ্ট।
হিংসা বিদ্বেষ ভুলে মসৃন পথ চলা নিশ্চিত করতে সুশিক্ষাই পারে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে। যার পেছনে প্রয়োজনীয় যোগান দিবেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক, স্নেহের শিক্ষার্থী, শ্রদ্ধেয় অভিভাবক ও সমাজের সুশিক্ষিত সচেতন নাগরিকবৃন্দ। আমরা সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সচল সমাজ বির্নিমানে অনেক দূর এগিয়ে যাবো। এ বিশ্বাস নিয়েই শেষ করছি। এর ব্যতিক্রম আমাদের ব্যথিত করে। ছাত্র শিক্ষকের মধুর সম্পর্ক আরো মধুর হোক। সমাজ সচলতায় সুশিক্ষা জায়গা করে নিক। সকলের জন্য শুভ কামনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *