সংবাদ শিরোনাম
Home / প্রথম পাতা / আহা, হাসপাতাল কত দূর! ||হাসান আকবর ||

আহা, হাসপাতাল কত দূর! ||হাসান আকবর ||

হাসান আকবর,সীতাকুণ্ড টাইমস

চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভয়াবহ অবনতি মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। একের পর এক মানুষ মরছে বিনে চিকিৎসায়। হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে জীবন দিচ্ছে মানুষ। অনেক আকুতি করেও কোথাও হাসপাতালে সিট জুটানো সম্ভব হচ্ছে না। করোনা আক্রান্ত হওয়া কিংবা উপসর্গ নেয়া রোগীতো বিনে চিকিৎসায় মরছেনই, অন্যান্য রোগেও বেঘোরে প্রাণ দিতে হচ্ছে মানুষকে। বেহাল এই অবস্থায় ‘চট্টগ্রামের হাসপাতাল কত দূর’ বলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে মরার জন্য হলেও হাসপাতালে ভর্তি হতে চাচ্ছেন। টাকা দিয়ে চিকিৎসা কিনতে চাচ্ছেন। তারা বিনে চিকিৎসায় স্বজন হারানোর এই মিছিল থামানোর আকুতি জানিয়েছেন।
সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর মোহাম্মদ ইব্রাহীম। সুস্থ সবল একজন মানুষ। তিন পুত্রের সকলেই প্রতিষ্ঠিত। এক পুত্র আমেরিকায় থাকেন। টাকা পয়সার কোন অভাব নেই। মোহাম্মদ ইব্রাহীম বাড়িতে থেকে ইবাদত বন্দেগী করে একজন প্রকৃত সুখী মানুষের মতো জীবন কাটান। কিন্তু সোমবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে মোহাম্মদ ইব্রাহীম এমনভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন যে, সন্তানদের কোন সান্তনাই রইলো না। ভয়াবহ সেই স্মৃতি হাতড়ে মোহাম্মদ ইব্রাহীমের ছেলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিন জানান, সকালেও আমার বাবা সুস্থ ছিলেন। প্রতিদিনের মতো ভোরে উঠে চা নাস্তাও করেন। দশটার দিকে হঠাৎই তার হাত পা অবশের মতো হয়ে যায়। তাকে জরুরি ভিত্তিতে জিইসি মোড়স্থ মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। দীর্ঘদিন ধরে যে কোন অসুখে বিসুখে মোহাম্মদ ইব্রাহীমের পরিবার এই ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। কিন্তু ওইদিন মেডিকেল সেন্টারে মোহাম্মদ ইব্রাহীমকে কোন চিকিৎসা দেয়া হয়নি। বহু অনুনয় করেও ভর্তি করানো যায়নি। এরপর জিইসি মোড় থেকে একে একে নগরীর সবগুলো হাসপাতালে ঘুরেন ইব্রাহীমের স্বজনেরা। কিন্তু কোথাও তাকে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। একটু অক্সিজেন চেয়েও পাননি। এভাবে একে একে নয়টি হাসপাতাল ঘুরে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান। ওখানে ভর্তি করানোর জন্য রাজি করানো গেলেও কেবিন না থাকায় ভর্তি করতে পারেননি। ওখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে অক্সিজেন দেয়া হয়। রোগীকে নেয়া হয় জেনারেল হাসপাতালে। ওখানেই এম্বুলেন্সের ভিতরে মোহাম্মদ ইব্রাহীম মারা যান। মোহাম্মদ ইব্রাহীমের করোনা ছিল না। ছিল না কোন উপসর্গও। একথা নানাভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে বুঝানোর চেষ্টা করেও স্বজনেরা কাউকে বুঝাতে পারেননি। অ্যাম্বুলেন্সে মারা যাওয়ার সময় বড় বড় চোখ করে সন্তানদের দিকে তাকাচ্ছিলেন মোহাম্মদ ইব্রাহীম। যেন প্রশ্ন করছিলেন হাসপাতাল আর কতদূর? আর কতদূর চিকিৎসা????
আরো করুণ ঘটনা ঘটে গেল মঙ্গলবার রাতে। অনেকটা বিনা চিকিৎসাতেই গভীর রাতে মুত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ১০ মাসের গর্ভবতী এক নারী। মারা যায় পেটের সন্তানও। গাইনী ডাক্তার বলেছিলেন সাতদিন পর বাচ্চা হবে। খুশীতে ভরপুর ছিল মুক্তার পরিবার। এর মধ্যেই মঙ্গলবার হঠাৎ প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয় মুক্তার। তাকে জরুরীভাব হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। কিন্তু কোথায় হাসপাতাল? কতদূরে??? অনাগত সেই বাচ্চা নিয়ে মুক্তা দিনভর ঘুরলেন হাসপাতালে-হাসপাতালে। টানা ১৮ ঘন্টা চেষ্টা করেও পুরো চট্টগ্রামে মেলেনি একটি আইসিইউ, একটু চিকিৎসা। বিনা চিকিৎসায় ঝরে গেল প্রাণ। পেটের সন্তানসহ মুক্তাকে কবর দেয়া হয় সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে। ঘটনাটি এলাকার মানুষকে শোকাচ্ছন্ন করেছে।
নগরীর বারিকবিল্ডিং এলাকার সাজেদা বেগম। টাকা পয়সার কোন অভাব নেই। অভাব নেই আত্মীয় স্বজনের। বাসায় শ্বাসকষ্ট শুরু হলে অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন মাপা হয়। ৮৮ শতাংশ পাওয়া যায়। পরিচিত এক চিকিৎসককে ফোন করা হলে তাকে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় স্বজনদের যুদ্ধ। স্বজনেরা তাকে নিয়ে যায় বেসরকারি হাসপাতাল সিএসসিআর-এ। ওখানে বলা হয় সিট খালি নেই। সাজেদা বেগমকে নিয়ে যাওয়া হয় মেট্রোপলিটন হাসপাতালে। না, জায়গা নেই। নেয়া হয় রয়েল হাসপাতালে। বলা হয় আইসিইউ বন্ধ। সিটি নেই। নেয়া হয় হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। গেটেই দারোয়ান জানিয়ে দেয় যে, করোনা চিকিৎসার ডেডিকেটেড হাসপাতাল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল থেকে বলে দেয়া না হলে রোগী ভর্তি করানো সম্ভব নয়। জেনারেল হাসপাতালের কাগজ লাগবে। পরে নেয়া হয় ম্যাক্সে। ওখান থেকে সিট না পেয়ে নেয়া হয় জেনারেল হাসপাতালে। রোগী মারা যায়।
খুলশি এলাকার একজন রোগী ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যান। অক্সিজেনের ঘাটতি ও সিট খালি নেই দেখিয়ে তারা রোগী ফেরত দেন। অতপর ঘুরতে ঘুরতে প্রাণ যায় রোগীর। দিন কয়েক আগে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে অনেকটা বিনে চিকিৎসায় মারা যান বেসরকারি কন্টেনার ডিপো এছাক ব্রাদার্সের মালিক হাজী মোহাম্মদ ইউনূস।গত ৯ জুন মঙ্গলবার সকালে বুকে ব্যথা নিয়ে শহরের কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে ঠাঁই না পেয়ে গাড়িতে প্রাণ হারালেন বায়েজিদ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম ছগীর। মঙ্গলবার সকালে বুকে ব্যথা অনুভব করলে শফিউল আলম ছগীরকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে স্বজনেরা নানা হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দেন। কিন্তু কোথাও চিকিৎসা পাননি। ছগিরের কোন করোনা উপসর্গ ছিল না। সকালেই তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন। কিন্তু কোন হাসপাতালে ঠাঁই না পেয়ে মাইক্রোবাসেই প্রাণ হারান তিনি। টাকা পয়সার অভাব ছিল না। ছিলনা আত্মীয় স্বজনের অভাব। রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তিরও কমতি ছিলনা। কিন্তু এত কিছু থাকার পরও হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে বিনে চিকিৎসায় মারা গেলেন তিনি।
শুধু এই কয়জনই নয়, প্রতিদিনই চট্টগ্রামে অসংখ্য মানুষ চিকিৎসা সংকটে এক ভয়াবহ সময় পার করছেন। যাপন করছেন এক অনিশ্চিত জীবন। টাকা দিয়েও চিকিৎসা না পাওয়ার এক ভয়াল পরিস্থিতি মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। করোনা আক্রান্ত না হয়েও নানা অসুস্থতায় দিশেহারা হয়ে উঠেছেন মানুষ। বিভিন্ন ধরনের শারিরীক জটিলতায় থাকা মানুষগুলো চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন। অভাবনীয় এই পরিস্থিতিতে কোথায় দাঁড়াবে মানুষ!!! সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, যাদের টাকা পয়সা আছে তারা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। টাকা পয়সা যাদের নেই তাদের অবস্থাতো আরো কঠিন। ভয়াল এই সময়টা পার করা সব মানুষের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। এদের অনেকেই চিকিৎসার জন্য এসেও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। অসহায়ভাবে নিয়তির হাতে নিজেদের সমর্পণ করতে হচ্ছে। করোনাকালে সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় মানুষ ক্রমে দিশেহারা হয়ে উঠছেন।
একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, আমরা চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদেরও তো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সব রোগীকে ভর্তি করানোর মতো অবস্থা নেই। আবার করোনা রোগীকে সাধারণ রোগীর সাথে ভর্তি করিয়ে সবাইকে ঝুঁকিতে ফেলাও সম্ভব নয়। তাই আমাদেরকে যাছাই বাছাই করে রোগী ভর্তি করতে হয়। করোনা উপসর্গ থাকলে সতর্কতার সাথে রোগী ম্যানেজ করতে হচ্ছে। তারা বলেন, আমরা কতজনকে ভর্তি করাতে পারবো কিংবা কতজনকে চিকিৎসা দিতে পারবো তার একটি সীমা আছে। পুরো চট্টগ্রামের সব রোগী একটি দুইটি হাসপতালের দিকে ছুটলে চিকিৎসা দেয়াতো কঠিন।
একজন চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের অনেকেই সাধারণ রোগীদের ভর্তি করাচ্ছেন না স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। তবে কিছুটা সিস্টেম অনুসরণ করলে রোগী ম্যানেজ করা কঠিন হতো না। স্ট্রোক বা হার্টের রোগীর কথা বলা হচ্ছে। যদি আলাদা এন্ট্রি দিয়ে প্রতিটি হাসপাতালে ঘণ্টা দুই ঘণ্টা একজন রোগীকে রেখে চিকিৎসা দিত তাহলে পরিস্থিতির এত অবনতি ঘটতো না। তিনি বলেন, যে কোন রোগী হাসপাতালে পৌঁছার সাথে সাাথে তাকে একটি বিশেষ কর্ণারে নিয়ে যাওয়া যায়। ওখানে অক্সিজেন সাপোর্টসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে একজন ডাক্তার ওই রোগীকে পরীক্ষা করতে পারেন। কিছু শারিরীক সিমটম এবং এক্সরে দেখলে একজন লোক কোভিড আক্রান্ত কিনা তা পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও অনুমান করা যায়। হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের রোগীর সাথে কোভিডের রোগীর বহু পার্থক্য রয়েছে। যে কোন চিকিৎসকই ঘণ্টা খানেকের পর্যবেক্ষনে তা নির্ণয় করতে সক্ষম। এখন হাসপাতালে আসা রোগীকে ওই বিশেষ কর্ণারে ঘণ্টাখানেক রেখে একজন চিকিৎসক যদি মনে করেন যে তিনি কোভিড রোগী তাহলে তাকে কোভিড হাসপাতালে স্থানান্তর এবং ননকোভিড হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, শ্বাসকষ্ট শুধু কোভিডের লক্ষণ নয়। হার্ট, স্ট্রোক কিংবা কিডনিসহ নানা রোগের শেষ পরিণতি শ্বাসকষ্ট। শ্বাসকষ্টের রোগী হাসপাতালে আসলেই তাকে কোভিড ভেবে দূর দূর করা কোন হাসপাতালেরই ধর্ম হতে পারেনা বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, প্রতিটি হাসপাতালেরই ইমার্জেন্সি রয়েছে। ইমার্জেন্সির পাশে পঞ্চাশ একশ’ বর্গফুটের একটি জায়গা বিশেষভাবে তৈরি করলে এক-দুইজন রোগীকে ঘণ্টা খানেক রেখে একটু পরখ করা কঠিন কিছু নয়। ওখানের বেড স্যানিটাইজ করা যায়। ঘর স্যানিজাইজ করা যায়। ওখানের ডাক্তারকে সুরক্ষা সামগ্রিতে সুরক্ষিত রাখা যায়। রোগী কোভিড আক্রান্ত হলেও ঘণ্টা খানেক সময় তাকে যথাযথভাবে ম্যানেজ করলে ওই রোগী ওই হাসপাতালের ক্ষতির কারণ হবে না। চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে ওই রোগী বরং সমাজের বেশী ক্ষতি করছেন বলে ওই চিকিৎসক মন্তব্য করেন। তিনি নগরীর সব সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে সব রোগী রিসিভ করে পরীক্ষার জন্য একটি কক্ষ তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছেন।
চট্টগ্রামের জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার শেখ ফজলে রাব্বি মানুষের কষ্টের কথা স্বীকার করে বলেছেন, আসলে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সামর্থের সীমাবদ্ধতা আছে। এই সীমাবদ্ধতার মাঝেও সরকার চট্টগ্রামের করোনা রোগীসহ সবার দোরগোড়ায় চিকিৎসাসুবিধা পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
গত কদিন ধরে স্বজন হারানো বহু মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে চিকিৎসা সংকট তুলে ধরছেন। টাকা দিয়েও চিকিৎসা না পাওয়ার অমানবিক এই কষ্ট অবসানের আকুতি জানিয়ে তারা বলেছেন, আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমাদের নিঃশ্বাস নিতে দিন।আমাদের হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ দিন। সুযোগ দিন চিকিৎসার। করোনাকালে বহু দূরে চলে যাওয়া হাসপাতালগুলোকে আবার আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।
সূত্র ঃ আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *