সংবাদ শিরোনাম
Home / প্রথম পাতা / ‘শায়খুল হাদিস মাওলানা হোসাইন আহমদ’র বর্ণাঢ্য জীবন আমাদের প্রেরণার বাতিঘর’

‘শায়খুল হাদিস মাওলানা হোসাইন আহমদ’র বর্ণাঢ্য জীবন আমাদের প্রেরণার বাতিঘর’

আরিফুল হক এনামী,সীতাকুণ্ড টাইমস ঃ

উত্তর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ইলমি আমলী ও আধ্যাত্মিক জগতের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব শায়খুল হাদীস আল্লামা আহমদ হোসাইন (রাহিমাহুল্লাহ)।
এ মনীষী ১লা জুলাই ১৯৪৪ ইংরেজি চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার দক্ষিণ সুখছড়ি (শাহ আবদুল খালেক রহ: এর পুরাতন বাড়ি) নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাওলানা আবদুল আজিম ও মাতার নাম আছিয়া খাতুন। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। পরিবারের সকল ভাই ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তার ছোট ভাই মাওলানা ওয়াহিদ আহমদ (মাদ্দাজিল্লুহ) দক্ষিণ সুখছড়ি খালেকিয়া ফাযিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও বড় ভাই মাওলানা মাকসুদ (রাহ:) লোহাগড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব ছিলেন। তিনি বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন হওয়ায় মা-বাবা ও উস্তাদদের প্রিয় ছিলেন।
প্রাথমিক শিক্ষা ঘরোয়াভাবে মা-বাবার কাছে শেষ করে চট্টগ্রাম জেলার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে সেখান হতে ফাযিল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে দাখিল, ১৯৬১ সনে আলিম ও ১৯৬৩ সনে ফাযিল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। অত:পর চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি দারসেগাহ দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা হতে ১৯৬৫ সালে কামিল কোর্স সম্পন্ন করে ১ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।
১৯৬৫ সনে কামিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেই তিনি উত্তর চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান সীতাকুণ্ড আলিয়া মাদ্রাসায় আরবি প্রভাষক পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে তিনি শায়খুল হাদীস পদে আসীন হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই পদেই হাদীসের দারস দিয়ে হাজারো ছাত্রদের মাঝে ইলমে নববীর জ্ঞান বিতরণ করেন। তিনি অত্র মাদ্রাসায় আমৃত্যু টানা প্রায় ৫৮ বছর শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। সরকারি নিয়ম অনুসারে ০১/০৭/২০০৪ সালে তিনি অবসর নেওয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ওফাতের আগমূহুর্ত পর্যন্ত শায়খুল হাদীস পদে বহাল ছিলেন। যেদিন তিনি ইন্তিকাল করেছেন সেদিনও মাদ্রাসার ক্লাস রুটিনে তার নামে সহীহুল বুখারী গ্রন্থটি বরাদ্দ ছিল।
গন্যমাণ্য বরেণ্য আলেম শায়খুল হাদীস হোসাইন আহমদ রাহিমাহুল্লাহর চারিত্রিক মাধুর্যতা অতুলনীয়।গনমানুষের উপকার সাধন, কল্যাণ কামনায় তার জীবনের যেন মূল লক্ষ্য। তিনি গরীব দুঃখী মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণে নিজের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করতে দ্বিধা করতেন না। এক কথায় তিনি যেন এক অনুস্বরনীয় চারিত্রিক বাস্তব নমুনা ও রোল মডেল। সফরের পূর্বে অজু করা তার অভ্যাস ছিল। নবীর প্রেমে এক উজ্জল দৃষ্টান্তও বটে। রাসুলুল্লাহ সা. এর সুন্নতের তাবেদার ছিলেন। হুজুরের একান্ত খাদেম মাওলানা আবদুল মান্নানের বর্ণনা মতে তিনি কখনো তাহাজ্জুদের সালাত মিস করতেন না। তিনি প্রায় ১৬ বার পবিত্র হজ্ব ও ১৫ বার পবিত্র উমরাহ পালনের জন্য পবিত্র মক্কা মদীনায় সফর করেছেন।
দীর্ঘদিন সীতাকুণ্ড কামিল মাদ্রাসায় হাদীসের খেদমতে থাকার কারণে সীতাকুণ্ড, মীরসরাই ও সন্ধিপ উপজেলার অধিকাংশ আলেম উলামা হুজুরের ছাত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। কেননা আলিয়া মাদ্রাসার মধ্যে উত্তর চট্টগ্রামের ইলমুল হাদীসের একমাত্র শানদার হাদিসের দারসেগাহ ছিল সীতাকুণ্ড কামিল মাদ্রাসা।
মাদ্রাসার প্রবীন শিক্ষক মাওলানা নুরুল আমীন সাহেবের বর্ণনা অনুসারে শায়খুল হোসাইন আহমদ (রাহিমাহুল্লাহ) নির্ধারিত ক্লাস সময় ছাড়াও সকাল ও রাতের বেলায় হাদিসের দারসে মগ্ন থাকতেন। তিনি আজীবন সহীহ বুখারী ও সুনানে নাসায়ীসহ জটিল জটিল সব কিতাবাদী ছাত্রদেরকে পড়াতেন। তিনি ইলমুল ফারায়েযে বিশেষ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন।তাই দুর-দুরান্ত থেকে মানুষ তার কাছে জমিজমার হিসাব ও ফারায়েযের সমাধান নেওয়ার জন্য ছুটে আসতো। তাছাড়াও বিশেষ ফাতওয়া ও শরয়ী সমাধানের জন্য সাধারণ মানুষ ও আলেম ওলামা তার কাছে আসতো। তাঁর দীর্ঘদিন শিক্ষকতা জীবনে অসংখ্য বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম, লেখক, গবেষক ও খ্যাতিমান আলিম তৈরি করেছেন। বর্তমান তার হাজার হাজার ছাত্র মাদ্রাসা, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বিভিন্ন দফতরে কর্মরত।
তাঁর উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্ঠায় সীতাকুণ্ড ও মীরসারাই উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় মসজিদ মাদরাসা, এতিমখানা মক্তবসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিশেষকরে সীতাকুণ্ড কামিল মাদ্রাসার নতুন ভবনসমূহ নির্মাণে তার অবদান অতুলনীয়।
শায়খুল হাদীস হোসাইন আহমদ রাহিমাহুল্লাহ দারসে হাদিসের পাশাপাশি দাওয়াতে ইসলামের খেদমতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। উত্তর চট্টগ্রামের প্রতিটি মহল্লার মসজিদ, মাকতাব ও মাদ্রাসার বার্ষিক সভা ও জলসায় তিনি মানুষদেরকে কুরআন হাদীসের বাণী শোনাতেন। তাই সাধারণ মানুষ তার অসংখ্য ভক্ত ছিল। শেষের দিকে তিনি সীতাকুণ্ড পৌরসভার হাসান গোমস্তা মসজিদ সংলগ্ন বাসায় অবস্থান করতেন এবং ছাত্র ও সাধারণ মানুষের মাঝে ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দিতেন। তিনি দীর্ঘদিন সীতাকুণ্ড কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে দুই ঈদের নামাযের ইমামতি করেছেন এবং নিজ গ্রামের খান মুহাম্মদ জামে মসজিদে জুমুয়ার খুতবা দিয়েছেন।
এই মহান পুরুষ ১২ই জানুয়ারি ২০২৪ ইং রোজ জুমাবার আনুমানিক রাত ১২.৪৫ টায় বার্ধক্যজনিত কারণে নিজ বাসভবনে ইন্তিকাল করেন। (ইন্না-লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) তিনি পারিবারিক জীবনে দুই ছেলে ও চার মেয়ের জনক। এইদিন বাদে আসর দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগড়া উপজেলার দক্ষিণ সুখছড়ি এলাকার সৈয়দ পাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। হাজারো ছাত্র, ভক্ত ও মুরীদদের উপস্তিতিতে তার সালাতুল জানাযা সম্পন্ন হয়। তার বড় মেয়ের জামাই ও ভাগিনা, চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা হাফিজুল হক নিজামী তার নামাজের ইমামতি করেন। আমরা মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছি, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন ও তার সকল ইলমি-আমলি খেদমত কবুল করে তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করেন। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *