সংবাদ শিরোনাম
Home / বিনোদন / সদগতি ———শাহনেওয়াজ বিপ্লব

সদগতি ———শাহনেওয়াজ বিপ্লব

শাহনেওয়াজ বিপ্লব,১৩জুন(সীতাকুন্ড টাইমস ডটকম)-
সালামের মানিব্যাগে নোটটা যেন জম্পেশ হয়ে আটকে গেছে। কড়কড়ে পাঁঁচশ টাকার নোট।

অবশ্য সালামকে এটা রোজগার করতে হয়নি। নোটটা এমনিই এসে গিয়েছিল। নোটগুলো সালামের কাছে অমন সহজেই আসে। কী একটা সরকারি কাজ করে। তার ডিপার্টমেন্টের নামটা, না জানানোই ভালো।

তার সই নাহলে সেই বিভাগের বহু কাজ আটকে যায়। তাদের রাস্তা-পুল-ব্রিজ এসব তৈরি করার কাজ। ঠিকাদারদের দিয়েই লাখ লাখ টাকার কাজ করাতে হয়।

সালামের সই না হলে ঠিকাদারদের লাখ লাখ টাকার বিলও পাশ হবে না। অনেকের টাকা আটকে যাবে। তাই বুদ্ধিমান ঠিকাদাররা কানের পানি বের করার জন্য আগেভাগেই কানে পানি দেন।

সেই সুবাদে সালামের পকেটে মুখ বন্ধ করা কিছু খাম যথারীতি আসে। এই পাঁচশ টাকার নোটটাও এসেছিল তেমনি কোনো খামে। একদিনে দু-তিনটে খাম আসে। সুতরাং সঠিক কোন খামের মধ্যে নোটটা ছিল, হদিসও করতে পারেনি গোপনে।

এখন এটা একাই আলাদা হয়ে রয়ে গেছে।

সেদিন মাছের বাজারে গেছে, সন্ধ্যায় লোডশেডিং। মোমবাতি জ্বেলে মাছওয়ালা হাঁকছে—

চাঁদপুরের ইলিশ! তিনশ টাকা কেজি মাত্র।

ইলিশই কিনতে যায় সালাম। মাছওয়ালা রুপালি ইলিশটা ব্যাগে দিয়ে নোটটা নিয়ে মোমবাতির সামনে ধরে দিক-ওদিক দেখে বলে,

—এটা বদলে দিন স্যার!

—মানে! সালাম অবাক হবার ভান করে।

এর আগে সে মুদির দোকানেও ঠেক খেয়ে এসেছে। বুড়ো মুদি চশমা আঁটা ঘোলাটে চোখে বলে,

—কেমন কেমন ঠেকছে। বদলে দিন এটা!

সালাম সেখানেও ঠেকেছে। আবার এখানে ঠেকতে হলো,

—কী হলো নোটটার?

মাছওয়ালা বলে—বদলে দিন না স্যার। কেমন ফ্যাকাসে রং লাগছে।

—নোটের আবার রং কী?

লোকটা বলে—আজকাল রংই সার কথা! বদলে দিন, না হলে ব্যাগে হাত পুরে মাছটা কেড়েই নেবে, এমন ভাব মাছওয়ালার।

সম্মানে বাধে সালামের, বাইরে সে ছয় হাজারি কেরানি। কিন্তু আড়ালে-তার আমদানি মাসে ফেলে-ছড়িয়ে হাজার বিশেক তো বটেই।

সুতরাং গরম তারও আছে। টাকার গরম।

তাই পকেট থেকে অন্য একখানা নোট বের করে বলে—

—এটার রং-চং ঠিক আছে তো?

মাছওয়ালা এবার আর কথা বলে না। নোটটা নিয়ে বাকি পয়সা ফেরত দিয়ে আবার চিল্লাতে থাকে—চাঁদপুরের ইলিশ, তিনশ টাকা কেজি…

গোপনে সালাম মাঝে মাঝে তবু চেষ্টা করে ওই নোটটাকে চালাতে। সেদিন গিন্নির ভাইঝির আকিকা। একটা আংটি না দিলেই নয়।

সোনার যা দর তাতে এইটুকু আংটির দাম পড়ে দেড় হাজার টাকা। চেনা দোকান। সালাম মাঝে মাঝে ওই খামগুলোর পাওয়া টাকা কিছু সোনায় রূপান্তরিত করে। কারণ স্ত্রীধনে স্বামীর হাত দেবার অধিকার নেই। তেমনি সরকারেরও। এই মাল ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই যেতে হয়, ওই কৃষ্ণ জুয়েলার্স-এর দোকানে।

আজ আংটি কিনে তিনটে পাঁচশ টাকার নোটের মধ্যে সেই নোটটাকেও মিশিয়ে দিয়েছে গোপনে। চেনা দোকানদার, গিলে নেবে নোটটাও।

কিন্তু সোনার দোকানিও একেবারে আলা-ভোলা নয়। নোটগুলো হাত নিয়ে উল্টে-পালটে ঠিক জাল নোটটাকেই বার করে দোকানদার বলে—

—এটা বদলে দিন ভাই!

সালাম একেবারে যেন কিছুই জানে না। বলে সে—

—কী হলো ওটার?

দোকানদার কষ্ঠিপাথরে সোনার দাগ কেটে সোনার শুদ্ধতা যাচাই করে। সুতরাং কাগজের নোট সহজেই চেনে সে। বলে—

—এটা পেলেন কোথায়?

চমকে ওঠে সালাম।

এ যেন গোয়েন্দার মতো জেরা করছে।

তবে কি এরা, তার খামের আমদানির খবর জেনে ফেলেছে।

সালাম সাবধানী স্বরে বলে—

—মনে হচ্ছে ব্যাংক থেকে তোলার সময় এসে গেছে। কেন?

দোকানদার বলে—সে কী? মনে হচ্ছে জাল নোট।

কাগজের রংটা কেমন ফ্যাকাসে।

সালামের সুন্দর মুখও ফ্যাকাসে হয়ে যায়! বলে সে,

—তাই না কি! দেখুন তো, কী লোকসান!

টাকাটা বদলে দেয় বাধ্য হয়ে।

নানাভাবে চেষ্টা করেছে সালাম ওই নোটটাকে সরাতে। কিন্তু সে ব্যাটা সরেনি। বরং তাকে সরাতে গিয়েই সালামকে নানা জায়গায় অন্য নোট দিতে হয়েছে। আর নোটটাও যেন সালামের প্রেমে পড়ে গেছে। ছেড়ে যেতে চাইছে না।

সালামের বন্ধু কবির নিরীহ গোবেচারা ধাতের মানুষ। কোনো সওদাগরি অফিসে কাজ করে। স্কুলের ভালো ছাত্রদের একজন ছিল কবির। সালাম ছিল অনেকটা বোকা টাইপের ছাত্র। সেই সালাম এখন শহরে মোটরবাইক দাবড়ে ঘোরে, আর কবিরের মাথায় ইয়া টাক, একটা ধ্যাড়ধেড়ে সাইকেলে চেপে প্রাণপণে প্যাডেল ঠেলে চড়াই-উতরাই ভেঙে চৌধুরীদের মালগুদামে যায় কাজ করতে। সংসারে পোষ্য সংখ্যাও কম নয়। ফলে টেনেটুনে চলতে হয়। আর কবিরের দেহে-মনে সেই দৈন্যের ছাপ ফুটে উঠেছে।

তবে, নিষ্ঠুর সংসারের আঘাত থেকে বাঁচার জন্য কবির এখন শহরের নামকরা দরবেশ মহাপুরুষ হজরত কালু শাহ-এর স্মরণ নিয়েছে।

শহরের একপ্রান্তে বিস্তীর্ণ পাহাড় কাছিমের পিঠের মতো বেঁকে শহুরে সমতলভূমির সাথে মিশে গেছে। দু-একটা মহুয়া-শাল গাছ অতীতের অরণ্যভূমির নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল এতকাল।

কয়েক বছর হলো বাবা কালু শাহ এসে এখানে এই চাটগাঁর ষোলশহর এলাকায় একটা বট গাছের নিচে মোমবাতি জ্বেলে বসেছিল। সেই যে বসল—তারপর কালু শাহ বাবা এখানে শিকড় গেঁড়ে বসলেন। ক্রমশ বেওয়ারিশ পতিত আধা পাহাড় আর আধা সমতলভূমির ওই জায়গায় গড়ে উঠল মাজার।

কিছু শিষ্যও প্রথমে গাঁজার লোভে এসে জুটেছিল। তারপর কালু শাহ বাবার নাম জাহির হবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দু-চারজন ছেঁড়া কাপড় পরে তার সাথেই রয়ে গেল। কারণ, আহার-নেশার দ্রব্য সবই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে ওখানে ততদিনে। শহরের এক শীর্ষ ধনী তো কোনো অজ্ঞাত কারণে কালু শাহ বাবার পয়লা নম্বর শিষ্য হয়ে গেল।

আধা পাহাড় আর আধা সমতলভূমির ওই জায়গায় গড়ে উঠল মাজার-মসজিদ। তৈরি হলো মুরিদদেরও আস্তানা। আর বেশকিছু গাছপালাও মাথা তুলল। কালু শাহ বাবাও মহীরুহের মতো শাখা-প্রশাখা মিলে এখানে গেঁড়ে বসল। শহরের বহু মানুষ-এমন কি চাটগাঁর নানা প্রান্তের গ্রামের মানুষের কাছে ক্রমশ কালু শাহ বাবা পুলসিরাত পার হবার কাণ্ডারি হয়ে উঠল।

কবির ক্রমশ তার ফাটা কপাল জোড়ার আশায় কালু শাহ বাবার চরণতলে এসে লুটিয়ে পড়লো। আর তার ক’মাসের মধ্যেই কবির হজরত কালু শাহ বাবার মুরিদ ওই শীর্ষ-ধনীর অফিসের ম্যানেজার হয়ে গেল। অর্থাত্ কালু শাহ বাবার কারসাজিতেই এইসব হয়েছে বলেই মানল কবির।

সেই থেকে কবির বাবার একনিষ্ঠ ভক্ত, কর্মী-প্রচারক-সংগঠক। বাবা বলেন,

—ওরে সেবা কর, দেখবি সব মনোবাসনা পূর্ণ হবে।

তা-ই করে চলেছে কবির। বাবার জন্মদিন উত্সবও পালিত হচ্ছে এখন ঘটা করে। বাবা বলেন মৃদু হেসে—এসব কেন?

কবিরই প্রধান উদ্যোক্তা, তার সঙ্গে অন্য ভক্তরা বলে,

—এ আমাদের একান্ত বাসনা বাবা!

বাবা বলেন করুণাভরে—ঠিক আছে। তবে বেশি সমারোহ করা কি ঠিক হবে রে!

অর্থাত্ সমরোহ করতে হবে, বাবা আমার মাঝে মাঝে ‘নেগেটিভ’ টার্মে কথা বলেন। সবই বাবার রহস্য!

মহা ধুমধাম করেই জন্মদিনের উত্সব হচ্ছে। মাজার চত্বরে বিরাট প্যান্ডেল তৈরি হয়েছে। ওদিকে ঢোল বাদ্য বাজিয়ে জিকির আজকার চলছে।

এদিকে চলছে তবররক বিতরণ। তারপর বাবা দর্শন দেবেন-দোয়া করবেন ভক্তদের।

প্যান্ডেলের ভেতর একটা উঁচু মঞ্চে ডেকোরেটারের দোকান থেকে সিংহাসন এনে বসানো হয়েছে। অবশ্য ওই সিংহাসনটা বিয়ের প্যান্ডেলে নতুন বরকেই বসতে দেখা যায়। সেখানে আজ বসেছেন ৮৮ বছর বয়সের কালু শাহ বাবা। পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি, গলায় সাতভরি সোনার হার—আরও কীসব রকমারি পাথরের মালা, তার ওপর ৮৮ টি ফুলের মালা। পায়ের কাছে সামনে রাখা বিরাট থালায় ভক্তরা সালামী দিচ্ছে। বাবা একবার আড়চোখে দেখছেন মাত্র। আজকালকার পাঁচমিশেলি ধাতুর দু’টাকার কয়েন-পাঁচ টাকা-দশ টাকার নোটের মধ্যে হঠাত্ একটা পাঁচশ টাকার নোট সালামী পড়তেই বাবা চোখ তুলে চাইলেন। ওই পাঁচশ টাকার নোট দেনেওয়ালা ভক্তটিকে বাবা নজরে রাখতে চান—ভবিষ্যত্-এর দোহনপর্বের জন্য।

দেখেন, লোকটির পাশে কবিরও রয়েছে।সালামী দিয়েছে সে-ই।

কবির বলে—বাবা, আমার বন্ধু সালাম। একে দোয়া করুন বাবা!

কালু শাহ বাবার তপোক্লিষ্ট মুখ মধুর হাসিতে ভরে ওঠে।

—তুই সালাম!

ওর মিনি কুলোর মতো হাতটা সালামের মাথায় রাখেন, কালু শাহ বাবা।

—এতদিন আসিসনি কেন রে? আজ মনে পড়লো বুঝি! পরে আসিস কিন্তু।

সালাম দেখছে বাবাকে।

ওই চাউনি সে চেনে।

ঠিক যেন তার চোখেরই চাউনি। সালাম ঠিকাদার বাবুদের হাত থেকে খামটা নিয়ে যেভাবে চায়, এ যেন অবিকল সেই খাম আদায়কারীর চাউনিই।

কালু শাহ বাবা বলেন—কবির, তোর বন্ধুকে তবররক নিয়ে যেতে বল।

…অবশ্য তবররকটা ভালোই!

ফাইন বাসমতী রাইসের বিরিয়ানী। একেবারে প্রতি কামড়েই গোশত পড়ছে ।

যে জাল পাঁচশ টাকার নোটটা এতদিন সালামের পকেটে আঠার মতো লেপটে থেকে শুধু লোকসানই করিয়ে গেছে—আজ সেই জাল নোট, ওই জাল কালু শাহ বাবার ঘাড়ে চাপিয়ে—তবররক খেয়ে কিঞ্চিত্ উশুল করে সালাম সরে পড়লো, দু’নম্বরি নোটেরও সদগতি হয়ে গেল!

বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়—যদি ধরা পড়ে যায়!

তাই সালাম ওই ভিড়ের মধ্যে থেকে কেটে পড়লো তবররক গ্রহণ করেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *